বিজ্ঞানী বনাব চার্চ (প্রথম পর্ব)

১৯৯২ সালের ৩১ অক্টোবর, পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন ক্যাথলিক চার্চ গ্যালিলিওকে ক্ষমা করে দিয়েছিল। সবাই নিশ্চয়ই এক ধরনের কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইবে গ্যালিলিও একজন বিজ্ঞানী মানুষ, তিনি কী এমন অপরাধ করেছিলেন যে ক্যাথলিক চার্চের তাঁকে শাস্তি দিতে হয়েছিল? আর শাস্তি যদি দিয়েই থাকে তা হলে তাঁকে ক্ষমা করার প্রয়োজনটাই কী? আর ক্ষমা যদি করতেই হয় তাহলে তাঁর জন্যে সাড়ে তিনশত বছর অপেক্ষা করতে হলো কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরগুলো প্রশ্নের মতই চমকপ্রদ। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও বলেছিলেন পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো সুর্যকে ঘিরে ঘুরে। ক্যাথলিক চার্চের মনে হয়েছিল সেটা বাইবেল বিরোধী বক্তব্য এবং সেই জন্যে তাঁরা গ্যালিলিওকে শাস্তি দিয়েছিল!

এখন আমরা খুব সহজেই স্বীকার করে নিই-যে পৃথিবীটা চ্যাপ্টা নয়, পৃথিবীটা গোল। যদিও দেখে মনে হয় চাঁদ সুর্য গ্রহ তারা পূর্বদিকে উঠে পশ্চিম দিকে অস্ত যায়-আসলে সে-রকম কিছু ঘটে না, পৃথিবীটা নিজ নিজ অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে বলে আমাদের সে-রকম মনে হয়। শুধু তাই নয় যদিও আমরা দেখেছি পৃথিবীটা স্থির সূর্যটাই উঠছে এবং নামছে আসলে সেটা সত্যি নয়। বিশাল সূর্যটাকে ঘিরেই ছোট পৃথিবীটা ঘুরছে। কিন্তু একসময় সেটা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করাও একটা ভয়ংকর রকমের অপরাধ ছিল। আসলে ঝামেলাটা পাকিয়ে রেখেছিল অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতো দার্শনিক আর গনিতবিদেরা। তারা বিশ্বাস করতেন পৃথিবীটাই সবকিছুর কেন্দ্র এবং সবকিছুই পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। তারা সেই সময়ের এত মহাজ্ঞানী ছিলেন যে, কেউ তাঁদের মতবাদকে অবিশ্বাস করেন নি। মোটামুটি সেই সময়েই অ্যারিস্টকাস নামে একজন অ্যারিস্টটল এবং টলেমির মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন যে, পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরে কিন্তু কেউ তাঁর কথাটাকে এতটুকু গুরুত্ব দেয় নি।
অ্যারিস্টটল আর টলেমির ভুল ধারণা পৃথিবীর মানুষ প্রায় আঠারোশত বছর পর্যন্ত বিশ্বাস করে বসেছিলেন। টলেমির ব্যাখ্যাটি ছিল জটিল,  যারা আকাশ-গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন তাঁদের কাছে গ্রহগুলোর গতিবিধি ব্যাখ্যা করাটি ছিল সবচেয়ে কষ্টকর। এই ভুল ধারণাটি প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন কোপার্নিকাস। তিনি দেখালেন যদি পৃথিবীর বদলে সূর্যকে কেন্দ্রস্থলে বসিয়ে দেয়া যায় গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি ব্যাখ্যা করা হয়ে যায় একেবারে পানির মতো সহজ। সবকিছু ব্যাখ্যা করে কোপার্নিকাস তাঁর বইটি লিখেছিলেন ১৫৩০ সালে কিন্তু সেই বইটি প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। অনেক ভয়ে ভয়ে বইটি ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৫৪৩ সালে। কথিত আছে বইটি যখন কোপার্নিকাসের কাছে আনা হয় তখন তিনি সংজ্ঞাহীন এবং মৃত্যুশয্যায়।


Partha's Blog
কোপার্নিকাস

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে বইটি প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে, বইটির প্রকাশক কোপার্নিকাসের অনুমতি না নিয়েই বইয়ের ভূমিকায় লিখে রেখেছেন যে, এই বইয়ের যে বিষয়টির কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটি সত্য নয়। গণনার সুবিধার জন্যে এটি একটি বিকল্প পদ্ধতি, এর সাথে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই! ধর্মযাজক এবং চার্চকে ভয় পেয়েই এই কাজ করা হয়েছিল সেটি বলাই বাহুল্য। কোপার্নিকাসের এই আবিষ্কারটি কিন্তু সবার চোখের অগোচরেই রয়ে গিয়েছেল দুটি কারণে, প্রথমত, বিষয়বস্তু এত অবিশ্বাস ছিল যে কেউ বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোপার্নিকাস বইটি লিখেছেন ল্যাটিন ভাষায় এবং ল্যাটিন ভাষা জানত খুব অল্পসংখ্যক মানুষ। গ্যালিলওর কারণে কোপার্নিকাসের মৃত্যুর ৭৩ বছর পর বইটি সবার নজরে আসে এবং ক্যাথলিক চার্চ সাথে সাথে ১৬১৬ সালে বইটি নিষিদ্ধ করে দেয়। 
গ্যালিলিওর জন্ম হয় ১৫৫৮ সালে এবং মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, যে বছর নিউটনের জন্ম হয়। আধুনিক বিজ্ঞানকে যারা গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের মাঝে গ্যালিলিও ছিলেন অন্যতম। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ের সাথে সাথে তাঁর জ্যোতির্বিজ্ঞানেও খুব আগ্রহ ছিল। তখন টেলেস্কোপ আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু এর গুরুত্ব কেউ ধরতে পারে নি, দূরের জিনিস কাছে দেখার একটা মজার খেলনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। গ্যালিলও যখন জানতে পারলেন টেলিস্কোপ বলে একটা যন্ত্র হয়েছে যেটা দিয়ে দুরের জিনিস দেখা যায় তখনই তিনি বুঝে গেলেন ওটার সত্যিকারের ব্যাবহার কি হতে পারে। অনেক খাটাখাটুনি করে তিনি একটা টেলিস্কোপ তৈরি করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র দেখলেন তিনি চাঁদের খানাখন্দ দেখলেন, বৃহস্পতির চাঁদ দেখলেন, এমনকি সূর্যের কলঙ্ক দেখলেন। (গ্যালিলও তখন জানতেন না সূর্যের দিকে খালি চোখে তাকানো যায় না। তাই সূর্য পর্যবেক্ষণের জন্য জীবনের শেষভাগে তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ) টেলিস্কোপকে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার যন্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করে তিনি যে সব জিনিস লিখলেন সেগুলো নিয়ে তিনি ১৬১০ সালে একটি বই লিখলেন। এই বইটিতে মুলত কোপার্নিকাসের মতাবাদকে সমর্থন করা হয়েছিল এবং এতদিনে যে কোপার্নিকাসের কথা কেউ জানত না, গ্যালিলিওর কারণে সেটি সবাই জানতে পারল। যার পরিণাম হলো ভয়াবহ। কোপার্নিকাসের বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো এবং গ্যালিলিওকে বলা হলো তিনি যেন এইসব মতবাদ প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন।

[দ্বিতীয় পর্ব]

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.