লুই পাস্তুর এবং তাঁর গবেষণা প্রক্রিয়া (প্রথম পর্ব)
১৮৮৫ সালের জুলাই মাসের চার তারিখ ফ্রান্সের একটি ছোট শহরে জসেফ মাইস্টার নামের নয় বছরের একটি বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিশাল এক কুকুর এসে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাচ্চাটিকে কুকুরটি সম্ভবত মেরেই ফেলত, কাছাকাছি একজন মানুষ দেখতে পেয়ে কোনোমতে একটা লোহার রড দিয়ে কুকুরটাকে তাঁড়িয়ে দিয়ে বাচ্চাটির প্রাণ রক্ষা করলো। আপাতত বাচ্চাটির প্রাণ রক্ষা হলো সত্যি কিন্তু বাচ্চাটির জন্য যে ভয়ংকর র্যাবিজ বা জলাতঙ্কে ভুগছে, বাচ্চাটিকে যেভবে আঁচড়ে কামড়ে কামড়ে ছিন্ন ভিন্ন করেছে তাতে বাচ্চাটিও যে এই রোগে মারা যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৮৮৫ সালে জলাতঙ্কের চিকিৎসা ছিল না, এটি যে একটি ভাইরাস বাহিত রোগ সেটাও কেউ জানতো না। এখনকার মানুষ যেমন জানে, তখনকার মানুষও জানতো র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক রোগের মৃত্যু থেকে ভয়ংকর কোনো মৃত্যু হতে পারে না। জ্বর দিয়ে শুরু হয়, অস্বাভাবিক এক ধরনের বিষণ্ণতা ভর করে সেটা পালটে যায় অনিয়ন্ত্রিত এক ধরনের উত্তেজনায়। গলায় মাংসপেশীতে এক ধরনের খিঁচুনি শুরু হয়, মুখ থেকে ফেনা বের হতে থাকে। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে চায় কিন্তু এক বিন্দু পানি পানি খেলেই খিঁচুনি শুরু হয়। শেষের দিকে পানি খেতে হয় না, পানি দেখলেই উন্মত্ত এক ধরনের খিঁচুনি ভর করে। চার- পাঁচ দিন পর যখন জলাতঙ্ক রোগীর মৃত্যু হয় সেটাকে সবাই তখন আশীর্বাদ হিসাবেই নেয়।
লুই পাস্তুর |
জোসেফ মাইস্টারের মা তাঁর ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার তাঁর ক্ষতস্থান পরিস্কার করে বললেন, তাঁর কিছুই করার নেই। শেষ চেষ্টা হিসেবে বাচ্চাটাকে প্যারিসে লুই পাস্তুরের কাছে নেয়া যেতে পারে। সারা পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই মানুষটিই যদি কোনো অলৌকিক উপায়ে বাচ্চাটির জীবন রক্ষা করতে পারেন, শুধু তাহলেই বাচ্চাটি বাঁচতে পারে। যে বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র সেটি হচ্ছে লুই পাস্তুর কোনো ডাক্তার নন, তিনি একজন রসায়ানবিদ। তাঁর বয়স তখন তেষট্টি, স্ট্রোকে শরীরের অর্ধেক অবশ। জীবন সায়াহ্নে এসে পৌছে গেছেন কিন্তু তখনও সারা দেশের মানুষের তাঁর ক্ষমতার ওপর অগাধ বিশ্বাস।
লুই পাস্তুর খুব বড় একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। বলা যায়, তাকে দিয়ে মাইক্রোবায়োজি বা আধুনিক চিকিংসাবিজ্ঞানের শুরু হয়েছে। জীবাণু বা ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব তাঁর চাইতে ভালো করে কেউ জানে না কিন্তু তিনি এখন ভাইরাস নামের অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে আসেছেন যেটা তখনো কেউ চোখে দেখে নি। বসন্ত রোগ বা জলাতঙ্ক রোগের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরেছেন কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ দিয়েও সেটাকে দেখতে পাওয়া যায় নি।
১৮৮০ সালে যখন লুই পাস্তুর তাঁর অর্ধেক অবশ শরীর নিয়ে র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক রোগের উপর গবেষণা শুরু করেছেন তখন এটি সম্পর্কে মাত্র তিনটি বিষয় জানা ছিল, একঃ র্যাবিজ বা জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালায় এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আছে, দুইঃ পশুর কামড়ে ক্ষতস্থান তৈরি হলে এই রোগের সংক্রামক হয়, এবং তিনঃ সংক্রামণের পর কয়েক দিন পর থেকে কয়েক সপ্তাহ পরে এই রোগের উপসর্গগুলো দেখা যায়। এর বাহিরে পুরোটাই একটা রহস্য।
লুই পাস্তুর খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। প্রথমেই চেষ্টা করলেন জলাতঙ্কের কারণটি আলাদা করতে। একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে হলে তাঁর রোগীর প্রয়োজন তাই লুই পাস্তুরের প্রথম কাজ হলো নিয়ন্ত্রিতভাবে পশুদের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের সংক্রামণ করানো। বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে র্যাবিজ আক্রান্ত হিংস্র পাগলা কুকুরের মুখ থেকে লালা সংগ্রহ করে সেটা দিয়ে খরগোশ বা কুকুরকে আক্রান্ত করার চেস্টা করে দেখা গেল এই পদ্ধতিটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। তা ছাড়া, সেটি ছিল খুব সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার। একটা পশুর মাঝে রোগের উপসর্গ দেখা দিতে যদি মাসখানেক লেগে যায় তাহলে সেটা নিয়ে তো আর ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা যায় না। দ্রুত আক্রান্ত করার একটা পদ্ধতি বের করতে হবে।
লুই পাস্তুর চিন্তা করতে লাগলেন, রোগের উপসর্গ দেখে মনে হয় এটি স্নায়ুর রোগ, মস্তিষ্কের যোগাযোগ আছে। জলাতঙ্ক আক্রান্ত পশুর লালা না নিয়ে যদি স্পাইনাল কর্ডের অংশবিশেষ সরাসরি পশুর মস্তিষ্কে ইনজেশান দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় তাহলে কি হয়? যেরকম চিন্তা সেরকম কাজ এবং লুই পাস্তুর মস্তিস্কে ইনজেকশান দিয়ে খুব নির্ভরযোগ্যভাবে দ্রুত তিনি পশুকে র্যাবিজ রোগে আক্রান্ত করিয়ে দিতে পারছেন। এখন তিনি গবেষণার পরের ধাপে পা দিতে পারেন, রোগের কারণটিকে আলাদা করে বের করা।
(দ্বিতীয় পর্ব)
(দ্বিতীয় পর্ব)
কোন মন্তব্য নেই