হাইপেশিয়া [এক মহীয়সী নারীর গল্প]

সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়গুলো মেয়েদের বিষয় নয় -- এগুলো হচ্ছে কাঠখোট্টা ছেলেদের বিষয়। কথাটা যদিও হালকা সুরে বলা হয়েছে কিন্তুু এর মাঝে সত্যতা আছে। ছেলেরা আর মেয়েরা কখনোই সমান অবস্থায় থেকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি কিংবা সাধারণ শিক্ষা-দীক্ষাতে ছেলেদের মতো অংশগ্রহণ করতে দেখি না। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা পুরুষ বিজ্ঞানী কিংবা প্রযুক্তিবিদ যেরকম পাই মেয়েদের সেই ভাবে পাই না, তুলনামূলক ভাবে তাঁদের সংখ্যা অনেক কম। ইদানীং তবু চোখে পরার মতো মহিলা বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদ দেখা যায়, অতীতে তাঁদের সংখ্যা ছিল একেবারেই হাতেগোনা।

সদূর-অতীতে - আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছরের আগে এরকম একজন মহিলা বিজ্ঞানী ছিলেন, তার নাম ছিলো হাইপেশিয়া। তিনি এমন একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন যাকে এতকাল পরেও অত্যান্ত শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করা হয়। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে মেয়েদের লেখাপড়া করার বা অন্য কিছু করার সুযোগ তো দূরে থাকুক তাদেরকে সামান্য সম্মানটুকুও দেয়া হতো না। সত্যি কথা বলতে কি সে সময়ে মেয়েরা ছিলো পুরুষের সম্পত্তি! সেই সময়ে হাইপেশিয়া শুধু যে একজন তুখোড় গনিতবিদ, সফল পদার্থবিদ প্রতিভাময় জ্যোতির্বিদ আর নিউপ্লেটোনিক দর্শন ধারার প্রধান ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির শেষ গবেষক।

হাইপেশিয়া



আলেকজান্দিয়া লাইব্রেরির গবেষক কথাটার মনে করে একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। আমরা পৃথিবীতে যে সভ্যতাটুকু দেখছি সেটার পিছনে যেটা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান। পৃথিবীতে আরো একবার বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা গড়ে উঠারর সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিলো এবং সেটা ঘটেছিলো আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিকে ঘিরে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে এই লাইব্রেরিটি গড়ে উঠেছিলো। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি ছিল সত্যিকার অর্থে একটি কসমোপলিটান শহর। পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এই শহরে থাকত। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর যে গ্রিক সম্রাটরা মিশর শাসন করত তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানের সাধনা করত। সেই দুই হাজার বছর আগে তারা গবেষণার গুরুত্বটি ধরতে পেরেছিল, তাই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিকে তারা গবেষণার একটা পরিবেশ তৈরি করেছিলো, যেখানে গবেষকেরা গনিত পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, জ্যোতিবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে শুরু করে ভূগোল বা সাহিত্যে গবেষণা করতেন! গবেষণার জন্য দরকার বই, তাই আলেকজান্দ্রিয়া ছিল এই প্রকাশনার স্বর্গ। বই বলতে আমরা যা বুঝি আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বই মোটেও সে রকম ছিলো না। প্রিন্টিং প্রেস ছিলো না বলে সেগুলো ছিলো হাতে লেখা। আসল কপিটা লেখক নিজে লিখতেন আর সেটা দেখে দেখে তার অন্য কপিগুলো আরেক জায়গায় লিখে রাখতেন! সে কারণে বই গুলো ছিল অসম্ভব মূল্যবান এবং যাদের কাছে সেই বইগুলো থাকত তাঁরা যক্ষের মতো আগলে রাখত। মিশরের গ্রিক সম্রাটরা অনেক কষ্ট করে সারা পৃথিবী থেকে অমূল্য বইগুলো সংগ্রহ করেছিল। কেউই তাঁদের আসল বইটি হাতছাড়া করতে চাইত না -- অনেক টাকা জামানত রেখে তাঁরা বইগুলো কপি করার জন্য আনত! সেই সময়কার গ্রিক সম্রাটরা বইগুলোকে এতই মূল্যবান মনে করত যে তাঁরা জামানতের টাকা বায়েজাপ্ত হতে দিয়ে সেই বইগুলো আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে রেখে দিত -- ফেরত দিত কোন একটা কপি। লাইব্রেরিতে ঠিক কতগুলো বই ছিল সঠিক ভাবে কেউ জানে না, অনুুুুুুমান করা হয় তাঁর সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশি ছিল। এই বিশাল লাইব্রেরিকে ঘিরে গবেষকরা যেসব কাজ করেছেন সেগুলো ছিল যুগান্তকারী। যেমন ইরাতোস্থিনিস প্রথম বারের মতো নিখুঁতভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্দ্ধ বের করে তাঁর একটা ম্যাপ তৈরি করেছিলেন, হিপার্কাস নক্ষেত্রের প্রকৃতির সঠিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তাদের নিখুঁত ক্যাটালগ তৈরি করেছিলেন। ইউক্লিড তার বিখ্যাত জ্যামিতির বই লিখেছিলেন, গেলেন লিখেছিলেন চিকিৎসা আর শারীরবিদ্যার বই। এরকম একটি - দুটি নয়, আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিভিত্তিক গবেষণার অজস্র উদাহরণ দেয়া যায়।

সেই লাইব্রেরির একজন গবেষক ছিলেন হাইপেশিয়া (Hypatia)। তার জন্ম হয় ৩৭০ সালে। তার বাবাও ছিলেন বড় দার্শনিক, নাম থিওন। সেই যুগে মেয়েরা যখন পুরুষের সম্পত্তি হয়ে ঘরের ভেতরে আটকা পড়ে থাকতো তখন হাইপেশিয়া সদর্পে পুরুষের জগতে ঘুরে বেড়াতেন। যে কোন হিসেবে হাইপেশিয়া ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী, তাকে বিয়ে করার জন্য পুরুষেরা পাগল ছিলেন কিন্তু তিনি কখনো বিয়ে করতে রাজি হন নি! কথিত আছে তার এক ছাত্র একবার তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন সেই ছাত্রকে তিনি মেয়েলী বিড়ম্বনার একটা নমুনা দেখিয়ে মোহমুক্ত করে ছেড়ে দিয়েছিলেন! এই সুন্দরী মহিলা নিয়মিতভাবে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিতে বক্তৃতা দিতেন--- তার বক্তৃতা শোনার জন্য অনেক দূর থেকে জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা আসত, রীতিমতো টিকিট কেটে তারা হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতো। হাইপেশিয়া যে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন তা নয়, আলেকজান্দ্রিয়া শহরের নগরপাল অরিস্টিসের সাথেও তার এক ধরনের ঘনিষ্টতা ছিল! তখন খ্রিস্টান ধর্মের প্রচার শুরু হয়েছে, খ্রিষ্টান আর্চ বিশপের নাম সিরিল। জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চাকে ধর্মান্ধ খ্রিষ্টানরা ধর্মবিরোধী মনে করত তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ধারক হাইপেশিয়া ছিল চক্ষুশূল। বিশেষ করে নগরপাল অরিষ্টিসের সাথে তার বন্ধুত্বকে সিরিল খুব খারাপ চোখে দেখতেন। হাইপেশিয়া খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন কিন্তু তার ধারণা ছিল ধর্ম হতে হবে আরো যুক্তিনির্ভর আর জ্ঞানভিত্তিক। হাইপেশিয়া তার বক্তৃতায় সেটা প্রচারও করতেন, গোঁড়া আর ধর্মান্ধ সেটা পছন্দ করতেন না। একজন মেয়ে হয়ে তার সাহসী কথাবার্তায় মানুষগুলো খুবই বিরক্ত হতো। তারা চেষ্টা করত যেন হাইপেশিয়ার বক্তৃতা শুনতে যেন না আসে, বিজ্ঞানের উপর কথাবার্তা কেউ শুনতে না পারে। কিন্তু এই তেজস্বী আর সুন্দরী মহিলাকে তারা কোন থামাতে পারলো না, তাই তাকে মেরে ফেলার সিন্ধান্ত নিলেন।

[হাইপেশিয়াকে যে নিষ্ঠুরতায় হত্যা করা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে তার উদাহরণ খুব কম রয়েছে।]

৪১৭ খ্রিষ্টাব্দে একদিন হাইপেশিয়া ঘোড়ার গাড়িতে ঘর থেকে বের হয়েছেন কাজে যাবার জন্য, পথে তাকে ঘিরে ধরলো ধর্মান্ধ মানুষেরা। মুহুর্তের মধ্যে সেই মানুষগুলো তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নেয়, তাকে বিবস্ত্র করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় একটা গির্জায়, সেখানে শরীর থেকে তার মাংস খুবলে খুবলে নেয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে, তারপর শরীর টুকরো টুকরো করে আগুনে ছুড়ে দেয় উন্মত্ত দানবের মতো। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নৃশংস হত্যাকান্ডের নজির খুব বেশি আছে বলে জানা নেই। এই হত্যাকান্ডের পরপরই আর্চ বিশপ সিরিলকে সাধারণ মানুষ থেকে উপরের স্তরে নিয়ে সেইন্ট বানিয়ে দেয়া হয়-- জগতে এইরকম রসিকতা আর কিছু হতে পারে? 
হাইপেশিয়াকে হত্যা করার সাথে সাথে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরিও দিন শেষ হয়ে যায়। এই লাইব্রেরিকে ঘিরে যে সভ্যতার বিকাশ থমকে দাড়ায় --- একদিন নয় দুইদিন নয়, প্রায় একহাজার বছরের জন্যে। হাইপেশিয়া যেন ছিলেন একটা আলোর শিখা, ফুঁ দিয়ে আলোর শিখা নিভিয়ে দেবার পর যেন পুরো জগৎটি এক হাজার বছরের জন্য অন্ধকারে ডুবে গেল। কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটনরা এসে সেই অন্ধকারকে দূর করার চেষ্টা শুরু না করা পর্যন্ত পুরো পৃথিবী এক হাজার বছরের জন্য অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল।

আলেকজান্দিয়ার সেই লাইব্রেরি একদিন পুড়ে ছাই করে দেয়া হলো-- ঠিক কারা করেছিল সেটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কথিত আছে লাইব্রেরির বই গুলো পুড়িয়ে গোসলখানার পানি গরম করা হয়েছে--- দশ লক্ষের উপর বই পুড়িয়ে শেষ করতে সময় লাগছে ছয় মাসেরও বেশি। পৃথিবীর ইতিহাসে এর থেকে হৃদয়বিদারক কোন ঘটনা আছে বলে জানা নেই। হাইপেশিয়ার সব বই গবেষণার সব নমুনা সেই লাইব্রেরির সাথে সাথে পুড়ে শেষ হয়ে গিছে। তার কাজের নমুনা বিশেষ কিছু এই নতুন পৃথিবীর মানুষ খুজে পায় নি--- ভাসা ভাসাভাবে নানা সুত্র থেকে কিছু তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যে কোন হিসেবে সেগুলো অসাধারণ। 
মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্যে ধর্মান্ধ মানুষেরা এই অসাধারণ বিজ্ঞানী এবং গনিতবিদকে কেটে টুকরো টুকরো করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। ধর্মান্ধ মানুষেরা ইতিহাসের পাতা থেকে কিন্তু মুছে দিতে পারে নি। আধুনিক পৃথিবীব মানুষ চাঁদের একটি অঞ্চলের নাম রেখেছে হাইপেশিয়ার নামে।
যতদিন আকাশে চাঁদ উঠবে ততদিন হাইপেশিয়া পৃথিবীর মানুষের কাছে বেচে থাকবেন জ্ঞানের প্রতীক হয়ে।

সুত্রঃ allthatsinteresting

1 টি মন্তব্য:

  1. অসাধারণ!
    তবে এই ভদ্র মহিলা যদি কোরআন পড়তেন তাহলে হয়তোবা ভিন্ন হিসাব হতো।
    ঠিক এমন একটা ঘটনাই ডা. আফিয়া সিদ্দিকার সাথে ঘটেছিল।

    উত্তরমুছুন

Blogger দ্বারা পরিচালিত.