টাইম মেশিন

সময় সম্পর্কে আমাদের ধারণা আইনস্টাইন পাল্টে দিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় ধারণা করা হতো সময় সবার জন্য এক। আমার বয়স যদি এক বছর বাড়ে তাহলে আমার বন্ধু আমার পরিচিত মানুষজন এমনকি অপরিচিত মানুষের বয়সও এক বছর বেড়ে যাবে। কিন্তু আইনস্টাইন দেখিয়েছেন তা সত্য নয়, যে মানুষটি বেশি ছুটাছুটি করেছে তাঁর বয়স একটু হলেও কম বেড়েছে, কারণ সময় সবার জন্য এক নয়, যার যার সময় তাঁর কাছে।
আমরা বিষয়টা ধরতে পারি না কারণ পৃথিবীর মানুষ যারা ছুটাছুটি করে তাঁদের গতিবেগ খুবই কম, সুপারসনিক প্লেনে বড় জোর তারা শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে যেতে পারে। কিন্তু সময়ের এই ব্যাপারটা চোখে পড়তে হলে একজনকে আলোর বেগের কাছাকাছি ছোটাছুটি করতে হবে। একজন মানুষ আলোর বেগের কাছাকাছি যেতে পারে না কিন্তু অনেক মহাজাগতিক কণা সহজেই সেটা পারে। এর সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হচ্ছে মিউওন, মহাজাগতিক কণা বায়ুমন্ডলের উপরে আঘাত করে এই মিউওনের জন্ম দেয়। মিউওনের আয়ু খুবই কম। এই কম সময়ের ভেতরে একটা মিউওন পুরো বায়ুমন্ডল ভেদ  করে পৃথিবীর পৃষ্টে উপস্থিত হওয়ার কোনো উপায় নেই, কিন্তু এটি সবসময় ঘটে থাকে। বায়ুমন্ডলের উপর থেকে পৃথিবীর পৃষ্টে আসতে যেটুকু সময় দরকার সেই সময়টুকু বাঁচে না তাই মিউওন কেমন  করে চলে আসে তাঁর ব্যাখ্যা খুবই সহজ। মিউওন তাঁর হিসেবে বেঁচে থাকে ক্ষুদ্র একটা সময়, কিন্তু আমাদের সময়টি মিউওনের ব্যাক্তিগত সময় থেকে ভিন্ন। যেটি অনেক দীর্ঘ। এই সময়ের ভেতর মিউওন দিব্যি বায়ুমন্ডলের উপর থেকে পৃথিবী-পৃষ্টে চলে আসতে পারে। সময় সম্পর্কে আমাদের কৌতূহল দীর্ঘদিনের। টাইম মেশিনে করে সময় পরিভ্রমণ করা সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন। সময় পরিভ্রমণ করে ভবিষ্যতে চলে যাওয়াটা তুলনামূলক সহজ। কেউ যদি একটা মহাকাশযানে করে প্রচণ্ড বেগে (আলোর বেগের কাছাকাছি) ছয় ঘন্টা ভ্রমণ করে কোথাও যায় তারপর দিক পরিবর্তন করে আবার ছয় ঘন্টা ভ্রমন করে পৃথিবীতে ফিরে আসে, তাহলে সে দেখবে পৃথিবীতে হয়তো দশ বছর হয়ে গিয়েছে। সে দশ বছর ভবিষ্যতে চলে গিয়েছে। এটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বিষয় নয়--- এটি আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরী অফ রিলেটিভীটির ভবিষ্যতবাণী। কিন্তু অতীতের কী যাওয়া সম্ভব? শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু টাইম মেশিনে করে সময় পরিভ্রমণ করার ওপরে একাধিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে। কিপ থর্ন নামে একজন পদার্থবিজ্ঞানী এই বিষয়ের উপর একটা গবেষণাপত্র (Wormholes, Time Machines, and The weak Energy Condition, Physical Review, Le Hers, 61, 1446,1448) প্রকাশ করেছেন, যেটি সময় পরিভ্রমণের মতো একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বিষয়ে পরিণত করেছে।

সময় পরিভ্রমণ করে অতীতে যাওয়ার বিষয়টি বোঝার আগে ওয়ার্ম হোল নামের বিষয়টি আগে বুঝতে হবে। ওয়ার্ম হোল হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দুটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গার ভেতরে একটি শর্ট কাট। ত্রিমাত্রিক জগতের ভেতরে একটি ওয়ার্মহোল কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু আমরা যদি বোঝার সুবিধার জন্য ত্রিমাত্রিক জগত হিসেবে কল্পনা করে নেই তাহলে বিষয়টি বোঝা সহজ হবে।

ওয়ার্ম হোল


ছবিতে একটি ওয়ার্ম হোল দেখানো হয়েছে। সব ওয়ার্ম হোলের দুটি মুখ থাকে। ওয়ার্ম হোল ব্যাবহার না করলে কেউ যদি অন্য গ্রহে যেতে চায় ধরি, তাকে ২০০ আলোকবর্ষ পার হতে হবে। কিন্তু সে যদি ওয়ার্ম হোলের ভেতরে টানেলটি দিয়ে যেতে চায় সে হয়তো ৫ কিলোমিটার অতিক্রম করে সেই জায়গায় পৌঁছে যাবে। এই টানেলটি হাইপার স্পেস ব্যাবহার করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দুটি ভিন্ন জায়গার ভেতরে একই শর্টকার্ট তৈরি করে দিয়েছে।

কেউ মনে করে না যে ওয়ার্ম হোলের এই বিষয়গুলো গালগল্প। আইনস্টাইনের সুত্রের সমাধান করে ১৯১৬ সালে প্রথমে এর অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। আইনস্টাইন, রোজেন হুইলারের মতো বড় বড় বিজ্ঞানীরা এর ওপর গবেষণা করেছেন। টাইম মেশিন তৈরি করতে এ রকম একটা ওহার্মহোল তৈরি করতে হবে। এই মুহুর্তে ওহার্মহোলের অস্তিত্ব হয়তো কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ কিন্তু দূর ভবিষ্যতে মানুষ যখন জ্ঞান বিজ্ঞানে লাগাম ছাড়া উন্নতি করতে পারবে তখন হয়তো ইচ্ছেমতো ওয়ার্ম হোল তৈরি করতে পারবে। মানুষ যখন সেরকম জায়গায় পৌঁছে যাবে তখন তারা একটা টাইম মেশিন তৈরি করার কথা ভাবতে পারবে। 

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.