সূর্য একটি প্রকাণ্ড হীরক খণ্ড
[সূর্যের জ্বালানি ফুরিয়ে যেতে এখনো ৫ বিলিয়ন বছর বাঁকি] |
সূর্যের ভেতরে ভর শক্তিতে রুপান্তরিত হওয়ার একটা বিশেষ প্রক্রিয়া রয়েছে, সেখানে হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রুপান্তরিত হয়ে হারিয়ে যাওয়া ভরটুকুকে শক্তি হিসেবে বের করে দেয়। একসময়ে সূর্যের প্রায় পুরোটুকুই ছিল হাইড্রোজেন। এখন এর ৭৪% হাইড্রোজেন এবং ২৫% হিলিয়াম এবং বাঁকি সবকিছু মিলিয়ে ১%। সূর্যের ভেতরে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামে পাল্টে গিয়ে শক্তি দেয়ার ব্যাপারটুকু ঘটে তাঁর কেন্দ্রের কাছাকাছি। মহাকর্ষ বলের কারণে গ্যাসের প্রচন্ড চাপের ফলে সেখানে তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি এবং সেখানেই নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হতে পারে। অনুমান করা হয় সূর্যের বর্তমান বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর এবং যতই দিন যাবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার পরিমাণ ততই বাড়তে থাকবে। আজ থেকে এক বিলিয়ন বছর পরে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য দশ ভাগ বেড়ে যাবে তখন পৃথিবী ছারখার হয়ে যাবে। প্রচণ্ড তাপমাত্রায় পৃথিবী জ্বলেপুড়ে যাবে, মানুষের বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। ( এক বিলিয়ন বছর অনেক দীর্ঘ সময়, মানুষ যদি সত্যি ততদিন বেঁচে থাকতে পারে তাহলে তাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত উন্নত হয়ে যাবে যে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো উপায় বের করে ফেলবে। )
[সূর্যের জ্বালানি যাবার পর সেটি পরিণত হবে বিশাল রেড জায়ান্টে] |
সূর্যের কেন্দ্রে যে হাইড্রোজেন্টুকু শেষ হয়ে যাবে আজ থেকে ৫ বিলিয়ন বছর পরে। তখন অত্যন্ত চমকপ্রদ কিছু ঘটনা ঘটবে। এতদিনে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম হওয়ার প্রক্রিয়ায় সূর্যের কেন্দ্রে শক্তি তৈরি হতো, সেই শক্তির কারণে বাহিরের দিকে যে চাপের সৃষ্টি হতো সেই চাপটা মহাকর্ষ বলকে ঠেকিয়ে রাখত। যখন হাইড্রোজেন শেষ হয়ে কেন্দ্রে শক্তি তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে গেল তখন মহাকর্ষ বলকে ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই, কেন্দ্রের পুরো হিলিয়ামটুকু তখন মহাকর্ষের প্রচণ্ড আকর্ষণে সংকুচিত হতে থাকবে এবং তাঁর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে সেটা এমন একটা তাপমাত্রায় পৌঁছাবে যে কেন্দ্রের কাছাকাছি যে হাইড্রোজেন ছিল সেগুলো নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু করে দেবে। যখন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া হতো কেন্দ্রের ভেতরে তখন শক্তি এবং চাপের একটা সমন্বয় ছিল এবং সে কারণে সূর্যের একটা নির্দিষ্ট আকার ছিল। এখন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হয়েছে কেন্দ্রের বাইরে এবং সেই শক্তির কারণে সূর্যটা হঠাৎ ফুলে-ফেপে উঠতে থাকবে। দেখতে দেখতে সূর্যটা ১০০ গুণ বড় হয়ে যাবে। সেই বিশাল সূর্যের আকার বুধ, শুক্র এমন কী পৃথিবীর কক্ষপথকে গ্রাস করে ফেলার কথা। পৃথিবী সম্ভবত রক্ষা পেয়ে যাবে কারণ তখন সূর্যের ভর শতকরা ২৪ ভাগ কমে গেছে, মহাকর্ষবলের আকর্ষণও কমে যাবে তাই কক্ষপথটাও বড় হয়ে যাবে। বিশাল এই সূর্যের এই রুপের নাম রেড জায়ান্ট বা লাল দৈত্য! সূর্যের ঔজ্জ্বল্য তখন আগের ঔজ্জ্বল্য থেকে ১০০ গুণ বেশি সেই প্রচণ্ড তাপমাত্রায় পৃথিবী তখন পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আমরা তখন থাকবো কিনা কেউ জানে না, বিবর্তনে আমাদের রুপ কেমন হবে সেটাও অনুমান করা কঠিন। তবে আমরা যদি ততদিনে টিকে থাকি তাহলে সূর্য রেড জায়ান্ট হয়ে পৃথিবীকে গ্রাস করার অনেক আগেই বিশাল মহাকাষ যানে করে আমরা পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো নক্ষত্রের অন্য কোনো সুন্দর গ্রহে গিয়ে আশ্রয় নিবো। অনেকে অনুমান করেন তাদের খুব বেশি দূরে যেতে হবে না বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহের চাঁদ ইউরোপা এবং টাইটান বেশ মানুষ্যবাসের উপযোগী হয়ে দাঁড়াবে।
সূর্যের এই বিশাল রুপকে রেড জায়ান্ট বা লাল দৈত্য বলা হয় তাঁর একটা কারণ আছে, এখন সূর্য থেকে সাদা রঙের আলো বের হয়, যখন এটি বিশাল রেড জায়ান্টে পরিনিত হবে তখন তাঁর থেকে লালচে আলো বের হবে। একটা নক্ষত্রের তাপমাত্রা যদি বেশি হয় তখন লীলাভ আলো বের হয়, তাপমাত্রা যদি কম হয় তখন সেই আলোর রং হয় কালচে। সূর্য রেড জায়ান্ট হবার পর তাঁর ভেতরে মোট শক্তি অনেকটাই বেড়ে যাবে কিন্তু সূর্যের আকারটাও তখন বিশাল, এই বিশাল পৃষ্ঠদেশ থেকে শক্তিটা বের হবে বলে গড় তাপমাত্রা অনেক কমে আসবে তাই সেটাকে সেখাবে লালচে। রাতের আকাশে যদি তারাগুলোকে লক্ষ করি তাহলে মাঝে মাঝেই দেখি কোনো তাঁরা লালচে আবার কোনোটা নীলাভ। এদের রংগুলো এরকম হওয়ার পেছনেও সেই একই কারণ।
সূর্য রেড জায়ান্ট হিসেবে ১০০ মিলিয়ন বছর টিকে থাকবে। এই সময়টাতে কেন্দ্রের কাছাকাছি হাইড্রোজেন থেকে তৈরি হওয়া হিলিয়াম কেন্দ্রে এসে জমা হবে। যখন যথেষ্ট পরিমাণ হিলিয়াম জমা হবে তখন মহাকর্ষ বলের আকর্ষণে কেন্দ্রের তাপমাত্রা আরো বাড়তে থাকবে, সেই তাপমাত্রায় এক সময় সূর্যের কেন্দ্রে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া শুরু হবে, তখন হিলিয়াম থেকে তৈরি হবে কার্বন। বাড়তি ভরটুকু আবার শক্তি হিসেবে বের হতে শুরু করবে। সূর্যের বর্তমান অবস্থায় শক্তি তৈরি হয় কেন্দ্রে এবং ধীরে ধীরে সেটা বাইরে বের হয়ে আসে তাই তাঁর আকারটুকু ছোট। রেড জায়ান্ট হয়ে যাবার সময় আকার বড় হয়ে গিয়েছিল, এখন তাঁর আকার ছোট হয়ে যাবে, আমরা এখন যে সূর্য দেখি তাঁর থেকে অল্প একটু ছোট। তবে তাঁর ভিতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রক্রিয়ায় শক্তি তৈরি হবে -- হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম নয়। কার্বন থেকে হিলিয়াম।
তবে এখন হিলিয়ামের পরিমাণ কম এবং দেখতে দেখতে ১০০ মিলিয়ন বছরের মাঝে সেটা ফুরিয়ে যাবে। সূর্যের কেন্দ্রে শক্তি তৈরি বন্ধ হয়ে যাব তাই কার্বন নিউক্লিয়াসগুলো মহাকর্ষবলে কেন্দ্রীভুত হতে থাকবে এবং তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এতো বেড়ে যাবে যে দ্বিতীয়বারের মতো কেন্দ্রের বাইরে থাকা হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রুপান্তরিত হতে শুরু করবে -- দ্বিতীয়বারের মতো সূর্য রেড জায়ান্টে পরিণত হয়ে যাবে। এবারের সেটি হবে আগের চেয়ে বড়, তাঁর আকার বৃহস্পতি কক্ষপথ পর্যন্ত হয়ে যাবে। এভাবে ১০০ মিলিয়ন বছর কেটে যাবার পর সূর্য তাঁর গ্যাস্টুকু হারাতে শুরু করবে।
ভেতরের কেন্দ্রটুকু তখন আবার সংকুচিত হতে শুরু করেছে। তাঁর তাপমাত্রাও বাড়তে বাড়তে ১০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছে যাবে। কিন্তু এখন আর নতুন করে কোনো বিক্রিয়া শুরু হবে না। সূর্যের এই সংকুচিত কেন্দ্রের আকার মাত্র কয়েক হাজার মাইল, পৃথিবীর কাছাকাছি। এটি এখন মৃত একটি উত্তপ্ত নক্ষত্র -- এর নাম হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন। (যদি সূর্যের ভর বেশি হতো তাহলে আরো চমকপ্রদ কিছু ঘটত কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার।)
নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী সুব্রাক্ষনিয়াম চন্ত্রশেখর প্রমান করেন যে, সূর্যের চেয়ে ১.৪ গুন কম ভরের কোনো নক্ষত্র বিফোস্করিত হয় না। সাদা বামন পর্যন্তই এর অন্তিম পরিনতি। ভরের এ সীমাকে চন্ত্রশেখর সীমা বলে।
[রেড জায়ান্টের পরবর্তী পর্যায়ে সূর্যের পরিণতি হবে হোয়াইট ডোয়ার্ফ নক্ষত্র ] |
সূর্যের বাঁকি জীবনটুকু সাদামাটা। উত্তপ্ত ক্ষুদ্র নক্ষত্রটি শীতল হতে শুরু করবে। কয়েক বিলিয়ন বছর নিয়ে সেটা ধীরে ধীরে শীতল হবে -- তাঁর থেকে তখন আলো বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, এই নক্ষত্রটিকে তখন বলা হবে ব্ল্যাক ডোয়ার্ফ বা কালো বামন।
কালো বামন আসলে অত্যন্ত ছোট জায়গার মাঝে মহাকর্ষবলের প্রচণ্ড তাপের মাঝে আটকে রাখা কার্বন নিউক্লিয়াস। কার্বন নিউক্লিয়াসকে প্রচণ্ড চাপ দিলে সেটা কেলাসিত হয়ে স্ফটিক বা ক্রিস্টাল হয়ে যায়। সেই ক্রিস্টালকে আমরা বলি হীরক বা ডায়মন্ড।
কাজেই আমরা এখন যেটাকে সূর্য হিসেবে দেখছি -- আজ থেকে আট-দশ বিলিয়ন বছর পরে সেটা হয়ে যাবে পৃথিবীর আকারের একটি অতিকায় হীরক খণ্ড। কেন জানি মনে হয় আমাদের পরিচত সূর্যের মূত্যুর পর হীরক খণ্ড হিসেবে কাটিয়ে দেয়াই বুঝি তাঁর জন্যে মানানসই একটি জীবন।
যদি সুর্যের ভর বেশি হতো তাহলে কি ঘটতো সেটা নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করা যাবে।
কোন মন্তব্য নেই