আমরা কি সত্যিই একা? (দ্বিতীয় পর্ব)
আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞনী হচ্ছেন এনরিকো ফার্মি, তিনি ড্রেকের সমীকরণ দেখে বিখ্যাত ফার্মির বিভ্রান্তি জন্ম দিয়েছিলেন, সেটা এরকম,
(ক) সত্যি যদি মহাজগতে বুদ্ধিমান প্রাণির অস্তিত্ব থেকে থাকত তাহলে এতদিনে তাদের পৃথিবীতে দেখা পাওয়ার কথা।
(খ) তাদের যদি পৃথিবীতে দেখা না পাওয়া যায় তাহলে বুজতে হবে মহাকাশযান তৈরি করে পৃথিবীতে আসার কোনো ক্ষমতা নেই।
(গ) সেটা যদি সত্যি না হয়ে থাকে তাহলে বুজতে হবে এই বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতা খুবই ক্ষণস্থায়ী। তাদের জন্ম হয় এবং কিছু বোঝার আগেই নিজেরা নিজেদের শেষ করে ফেলে!
এনরিকো ফার্মি যে খুব চিন্তাভাবনা করে তাঁর এই বিভ্রান্তিটির জন্ম দিয়েছে তা নয়, বলা হয়ে থাকে দুপুরের খাবার খেতে খেতে ঠাট্টার ছলে কথাগুলো বন্ধুদের বলেছিলেন এবং এখন যারাই মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে চিন্তাভাবনা করে তাঁরা কোনো না কোনো ভাবে এনরিকো ফার্মির বিভ্রান্তির কথা জানে। প্রথম দুটোর কথা ছেড়ে দিয়ে আমরা তৃতীয়টা নিয়ে একটু ভাবতে পারি।
আমরা মানুষেরা নিজেদের খুব উন্নত এবং বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করি। কিন্তু ইতিহাস পড়লে সেটাকে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। যুদ্ধবিগ্রহ করে মানুষ একে অন্যকে কতভাবে খুন করেছে সেটি কেউ চিন্তা করে দেখেছে? পুরো একটি সভ্যতাকে অন্য একটি সভ্যতা এসে ধ্বংস করে দিয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি আমাদের মনে হয় এই মুহুর্তে আমরা ঠিক এ-রকম একটা সময়ের মাঝে আছি। চেঙ্গিস খানের আমলে মানুষ খুন করা পরিশ্রমের ব্যাপার ছিল, কারণ তখন তরবারি দিয়ে আরেকজনকে কাটতে হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনী সেটাকে আধুনিক করে ফেলেছিলো। গ্যাস চেম্বারে মারা থেকে শুরু করে অনেক বিজ্ঞানসম্মত উপায় তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিধ্বংসী নিউক্লিয়ার বোমা মেরে ফেলে হত্যাকাণ্ডের একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিল। তাঁর সাথে সাথে এই পৃথিবীতে মানুষ টিকে থাকবে কিনা সেটা নিয়ে একটা প্রশ্নও প্রথমবার তৈরি হয়েছে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা করে পৃথিবীর নানা দেশের কাছে এখন যে পরিমাণ মানব বিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে সেই অস্ত্র দিয়ে এই পৃথিবীর সকল প্রানীকে একবার নয় অসংখ্যবার ধ্বংস করা যায়। তারপরেও আমরা কি মানুষকে সভ্য মানুষ বলতে পারি?
আমাদের পছন্দ হোক আর না হোক এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে এ-রকম একটা পরিস্থিতি হওয়া সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্যে। চেঙ্গিস খান ধারালো তরবারি দিয়ে কুপিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে শেষ করে ফেলতে পারত না কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ইচ্ছে করলে সব মানুষকে মেরে শেষ করতে পারে। একবার নয় বহুবার। তাঁর কারণ চেঙ্গিস খানের কাছে নিউক্লিয়ার বোমা ছিলো না। কিন্তু, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে আছে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক সুত্র E = mc2 তখন কি তিনি সন্দেহ করেছেলেন এটা দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মরণাস্ত্র তৈরি হবে? পরামাণুর বড় একটি নিউক্লিয়াস ভেঙে দু টুকরো করা হলে তাঁর বাড়তি ভরটুকু শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসে। ভর বা m কে E বা শক্তি তৈরি করা হলে সেটাকে c বা আলোর বেগ দিয়ে দুবার গুন করতে হয়, তাই একটু খানি ভর দিয়ে অনেখানি শক্তি পাওয়া যায়। সাধারন বোমার ধ্বংস করার ক্ষমতা থেকে নিউক্লিয়া বোমার ধ্বংস করার ক্ষমতা এত বেশি। যে পরমানুর নিউক্লিয়াস দিয়ে এটা প্রথম করা হয়েছিলো সেটি ছিলো ইউরেনিয়ামের।ইউরেনিয়ামের পরামাণু সংখ্যা হচ্ছে ৯২। তাই এই সংখ্যাটির একটা অন্যরকম গুরুত্ব রয়েছে। মানুষ যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে প্রথমবার ৯২ নম্বর পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভেতর থেকে ভয়ংকর শক্তিটা বের করতে পেরেছে ঠিক তখনই তাঁরা সারা জীবনের জন্যে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে। কারণ, তাঁরা ঠিক তখন প্রথমবার তাঁরা পৃথিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। মানুষ তাদের নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবে কিনা সেটি কেউ এখনো জানে না। কিন্তু সেই ক্ষমতাটি যে তাঁর কাছে সেটি সবাই জানে। একটি বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতা যখন বিকশিত হয় তাদের অস্তিত্বের প্রথম বিপদটি আসে এই ৯২ পরমাণু থেকে। এর থেকে উত্তরণ হবার পরেই বলা যায় তাঁরা ৯২-এর বাধা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
পৃথিবীতে মানুষ যেভাবে বিবর্তনের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিকশিত হয়ে একসময় ৯২-এর ভয়ংকর বিপদের মুখোমুখী হয় ঠিক সেরকম অন্য কোনো গ্যালাক্সির অন্য কোনো নক্ষত্রে অন্য কোনো গ্রহে যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর উদ্ভব হয় তাহলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হয়ে তারাও এক সময় ৯২ নম্বর পরামাণু থেকে শক্তি বের করার রহস্যটি জেনে যাবে। মানুষ যেভাবে তাদের নিজেদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করার মুখোমুখি হয়েছে সে-রকম তাঁরাও সেই নিজেকে ধ্বংস করার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াবে।
তারপর কী হয় আমরা জানি না। এনরিকো ফার্মি ভয় পেয়েছেন বুদ্ধিমান প্রাণী হয়তো নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। মানুষও বুদ্ধিমান প্রাণী, তাই হয়ত আমরাও নিজেদের ধ্বংস করে ফেলব! হয়ত সৃষ্টিজগতে অনেক প্রাণের উদ্ভব হয়েছে কিন্তু বুদ্ধিমত্তার জন্যে তাদের খুব বড় মুল্য দিতে হয়েছে। সে কারণে হয়তো বুদ্ধিমান প্রানীরা সব সময়ই একা। সব সময়ই নিঃসঙ্গ।
কোন মন্তব্য নেই